নেতৃত্ব, লড়াই ও লংমার্চের প্রতীক ফারাক্কা দিবস

মোঃএরশাদ, মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি :
আজ ১৬ মে—বাংলাদেশের পানি-সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবময় দিন। ১৯৭৬ সালের এই দিনে, দেশের খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ। এটি ছিল দেশের প্রথম সর্বজনীন পানি-অধিকার আন্দোলন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনায় গভীর ছাপ রেখে গেছে।
৯৬ বছর বয়সেও লাখো মানুষের অংশগ্রহণে যে লংমার্চ সংগঠিত হয়েছিল, তা আজও প্রমাণ করে—প্রকৃত নেতৃত্ব মানেই কেবল বক্তব্য নয়, জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব ও সাহসী পদক্ষেপ।
ফারাক্কা বাঁধ সংকটের শুরু
ভারত ১৯৬১ সালে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে এবং ১৯৭৫ সালে সেটি সম্পন্ন করে। একই বছর ভারত পরীক্ষামূলকভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার শুরু করলে বাংলাদেশের নদীগুলোর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে পদ্মাসহ দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নদী শুকিয়ে যেতে থাকে। উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা হয়ে পড়ে পানির জন্য অনুপযুক্ত। কৃষি, জীববৈচিত্র্য, মিঠা পানির উৎস ও নদীভাঙন পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়।
পানি সংকট জনজীবনকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ফেললেও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা তখন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। সেই শূন্যতা পূরণে জনগণের পাশে দাঁড়ান মওলানা ভাসানী।
লংমার্চ জনতার জাগরণ
এই প্রেক্ষাপটে ১৬ মে ১৯৭৬ সালে পাবনার ভাঙুড়া থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী পর্যন্ত প্রায় ৫০ মাইল দীর্ঘ পদযাত্রার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় ফারাক্কা লংমার্চ। মওলানা ভাসানীর আহ্বানে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। স্লোগান ওঠে—“ভাসানীর নির্দেশ, ফারাক্কা ভাঙো”।
লংমার্চটি ছিল নিছক প্রতীকী প্রতিবাদ নয়, বরং একটি সুসংগঠিত বার্তা—বাংলাদেশ তার ন্যায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হবে না। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় নীরবতার বিরুদ্ধে সাহসী ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া।
আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারতের পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন—বিশেষ করে জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের জলপ্রবাহ কনভেনশনের—স্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ বাংলাদেশ আজও ওই কনভেনশনের অনুসমর্থন করেনি। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ইস্যুতে দৃশ্যমান কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি।
বর্তমানে তিস্তা, মহানন্দা, ধরলা, দুধকুমারসহ প্রায় আড়াই ডজন আন্তঃসীমান্ত নদীর ওপর ভারত একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান অনেকাংশেই নিষ্ক্রিয় রয়ে গেছে।
তিস্তা চুক্তির স্থবিরতা
দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পরও তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি এখনো সম্পাদিত হয়নি। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কারণে চুক্তি বারবার থমকে গেছে। এর ফলে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা কৃষিকাজের জন্য পানির অভাবে ধুঁকছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পানির বিষয়টি কেবল কূটনৈতিক নয়; এটি আজ জাতীয় নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশগত টিকে থাকার প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।
ফারাক্কা দিবস: অতীত নয়, ভবিষ্যতের পথনির্দেশ
প্রতি বছর ১৬ মে ‘ফারাক্কা দিবস’ হিসেবে পালিত হলেও, তা যদি কেবল স্মৃতিচারণে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে মওলানা ভাসানীর ত্যাগ ও দূরদর্শিতার অবমূল্যায়নই হবে। এখন সময় এসেছে নতুন প্রজন্মকে এ আন্দোলনের গুরুত্ব বুঝিয়ে তোলা এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জল-কূটনীতিকে জোরদার করার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মুহূর্তে দরকার তিনটি প্রধান পদক্ষেপ— আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টনে আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর ব্যবহার,জাতিসংঘের জলপ্রবাহ কনভেনশনে দ্রুত অনুসমর্থন,প্রবাসী ও আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে সমন্বিত কূটনৈতিক প্রচারণা।
উল্লেখ্য,মওলানা ভাসানী দেখিয়ে গেছেন—জনগণের স্বার্থে একজন নেতা কীভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারেন। ফারাক্কা লংমার্চ সেই ইতিহাসের অংশ, যা শুধু অতীত নয়, বরং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ। আজকের দিনে প্রয়োজন সেই সাহসী নেতৃত্ব ও সচেতন নাগরিক অংশগ্রহণ, যা বাংলাদেশের পানি-অধিকারের লড়াইকে সফলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।