চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে চলছে পাহাড়কাটার উৎসব

অবৈধভাবে পাহাড়কেটে তৈরি করা হচ্ছে বিলাসবহুল বহুতল ভবন। অবৈধভাবে ভবন নির্মাণের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ। নগরীর জামালখান এলাকায় অবৈধভাবে নির্মিত ভবনে এই অভিযান চালায়। এসময় সিডিএ অবৈধভাবে নির্মিত ভবনটি গুড়িয়ে দেয়। সকাল ১১টার দিকে সিডিএ’র চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিমের নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। সিডিএ চেয়ারম্যান জানান, নগর উন্নয়ন এবং বহুতল ভবনের নির্মাণের ক্ষেত্রে নজরদারি আরো কঠোর করা হবে। আনা হবে জবাবদিহিতার আওতায়।
চট্টগ্রামের ব্যস্ততম এলাকা জামালখান, এস.এস খালেদ রোডে টিনের ঘেরা দিয়ে নির্বিগ্নে পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হচ্ছিল বহুতল এই ভবন। প্রায় ৩০কাঠার জমিতে সিডিএ পাহাড়টিতে ১৪তলা ভবন নির্মাণের অনুমুতি দেয় সিডিএ। জেলা প্রশাসন পাহাড়ের শ্রেণী পরিবর্তন করে।
পরিবেশ কর্মিদের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামে গত চার দশক আগেও ২০০টির বেশি পাহাড় ছিল। ভূমিদস্যুদের কুনজরে পড়ে ১২০টির বেশি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে বিলুপ্ত হয়েছে ৮৮টি পাহাড়। একই সময়ে আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫টি পাহাড়। আর গেল কয়েক বছরে বিলিন হয়েছে আরো অন্তত:৩২ পাহাড়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ১৫টি পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোড বাইপাস সড়ক নির্মাণ করেছে। অন্যদিকে, সীতাকুন্ড ও চট্টগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাওয়া পাহাড়গুলোকে ঘিরে কয়েকদশক ধরে অবৈধ বানিজ্য চালিয়ে আসছে প্রভাবশালীরা। শুধু এ রোড নয় দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার পাহাড়গুলো আজ প্রায় ধ্বংসের পথে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দু’য়েকটা অভিযান হলেও অর্থদন্ডেই তার সমাধান হয়ে যায়। ফলে প্রভাবশালী চক্রের সদস্যরা প্রশাসনের এসব অভিযানকে তেমন পরোয়া করে না।
সিডিএ’র আইন উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মি এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান জানান, সমতল থেকে ১২৭ফুট উচ্চতায় নির্মাণকারা এই বহুতল ভবনটি ইমারত নির্মাণ কমিটির কাছ থেকে অবৈধভাবে অনুমোদন নেয়। ভূমিদস্যরা পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণ করলে সিডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারী সংস্থাগুলি কোন কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। তিনি সর্তক করে দিয়ে বলেন, পাহাড় কেটে চট্টগ্রামে আর ভবন করতে দেয়া হবে না। এক্ষেত্রে সিডিএ আরো কঠোর হবে।
এদিকে, সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম জানিয়েছেন, ভবন নির্মাণে নকশা প্রনয়নসহ জমির ছাড়পত্র প্রদান এবং ভবন নির্মাণে নজরদারি আরো বাড়ানো হবে। চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষাসহ আইনি ব্যবস্থার সংস্কারের কথাও বলেন তিনি।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে সরকারি-বেসরকারি ২৬টি পাহাড়ে ছয় হাজার ৫৫৮টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের মালিকানাধীন ১৬টি পাহাড়ে বসবাস করছে ছয় হাজার ১৭৫টির বেশি পরিবার। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩৮৩টি। রেলওয়ের মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবৈধ পরিবারের বসবাস নগরীর ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল পাহাড়ে। এখানে চার হাজার ৪৭৬টি পরিবার থাকে। এছাড়া মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল এলাকায় বসবাস ৪৩১টি পরিবারের। লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয় নগর পাহাড়ে বসবাস ২৮৮টি পরিবারের। রেলওয়ের মালিকানাধীন ষোলোশহর স্টেশনসংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৭৪টি, নগরীর জাকির হোসেন সড়কে পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬টি, পলিটেকনিক হক স্টেশনসংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ১২টি এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ফৌজি ফ্লাওয়ার মিলসংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে পাঁচটি পরিবারের বসবাস রয়েছে। সব মিলিয়ে ছয় হাজার ৫৫৮টি অবৈধ স্থাপনার মধ্যে রেলওয়ের জমিতে রয়েছে পাঁচ হাজার ৩৩২টি স্থাপনা।
এদিকে নির্বিচারে পাহাড়কাটার কারণে পাহাড়ধ্বসে চট্টগ্রামে গত দেড় দশকে ২০০ এর বেশি মানুষ মারা গেছে। কিন্তু বরাবরেই পাহাড় খেকোরা থেকে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৯ জন মারা যাওয়ার পর শক্তিশালী পাহাড় রক্ষা কমিটি ৩৫দফা সুপারিশ করে। কিন্তু সেসব সুপারিশ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি পাহাড় রক্ষায় বেলার দায়ের করা মামলায় ২০১২ সালের ১৯ মার্চ হাইকোর্ট সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিলেও সে নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে দিনে দিনে পাহাড়খেকোর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ জন্য প্রশাসনকে আরো কঠোর হওয়ার কথা বলছেন চট্টগ্রামের পরিবেশবিদরা

আলী মুর্তজা রাজু

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধ্রুবকন্ঠ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button